Bangladesh-fish-hospital

বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতাল

Bangladesh Fish Hospital

Since 2016

জলাশয়ে সাকার মাছের ক্ষতিকর প্রভাব ও জলাশয়কে সাকার মুক্তকরার
কলাকৌশল

সাকার ফিশের আসল নাম সাকার মাউথ ক্যাটফিশ। এর বৈজ্ঞানিক নাম হিপোসটোমাস প্লেকাসটোমাস।
আশির দশকে অ্যাকোয়ারিয়ামের শেওলা ও ময়লা পরিষ্কার করতে এই মাছ বিদেশ থেকে আনা হয়।
শ্যাওলা খেয়ে কাচকে পরিস্কারও রাখে এ মাছ। কিন্তু অ্যাকুরিয়ামের এ মাছ এখন ছড়িয়ে পড়েছে
বিভিন্ন নদ-নদী এবং জলাশয়েও। এই মাছ দক্ষিণ আমেরিকায় ব্যাপকভাবে দেখা যায়। তবে কয়েক
বছর ধরে তা ভারত, চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের জলাশয়ে দেখা যাচ্ছে। সাকার মাছের পিঠের ওপরে
বড় ও ধারালো পাখনা আছে। দুই পাশেও রয়েছে একই রকমের দুটি পাখনা। এর দাঁতও বেশ ধারালো।
সাধারণত জলাশয়ের আগাছা, জলজ পোকামাকড় ও ছোট মাছ এদের প্রধান খাবার। যেসব পানিতে
দূষণের কারণে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে, সেখানে অন্য মাছ বাঁচতে পারে
না, তবে এই মাছ পারে। পানি ছাড়াও মাছটি ২৪ ঘণ্টা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে।

দেশের নদী-বিল তো বটেই, ডোবা-
নালাতেও হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে
সাকার মাউথ ক্যাটফিশ। জলজ
বাস্তুসংস্থান ও দেশি মাছের
অস্তিত্বের জন্য ভয়ানক হুমকি
হয়ে উঠেছে এ মাছ। তাই এ মাছটিকে
কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এর বিকল্প
ব্যবহার নিয়ে ভাবছেন গবেষকরা।
গবেষকরা বলছেন, রাক্ষুসে
প্রজাতির না হলেও সাকার ফিশ
প্রচুর খাবার খায়। বংশ বিস্তার
করে দ্রুত। জলজ পোকামাকড় ও
শ্যাওলার পাশাপাশি ছোট মাছ এবং মাছের পোনাও খেয়ে থাকে সাকার। তা ছাড়া এ মাছের পাখনা খুব
ধারালো হওয়ায় এর আঘাতে সহজেই অন্য মাছের দেহে ক্ষত হয় এবং পরে পচন ধরে মারা যায়। দেশের
বুড়িগঙ্গাসহ বিভিন্ন নদী ও জলাশয়ে এখন সাকার মাছের সঙ্গে দেশীয় প্রজাতির মাছের খাদ্যের
জোগান নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতার আশঙ্কা করছেন গবেষকরা। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্য ও
বাসস্থানের জন্য এই প্রতিযোগিতা উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশীয় মাছ ও পুকুরে চাষের মাছের উৎপাদনেও
বাধা সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট ও বাস্তুসংস্থান ধ্বংস করার মাধ্যমে জলাশয়ের
উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিতে পারে। তা ছাড়া দ্রুত বংশবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সাকার মাছ জলাশয়ের পাড়
ধ্বংস, দেশীয় প্রজাতির মাছের ডিম ও রেণু ভক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করাসহ নানা ক্ষতি
করতে পারে। মৎস্য ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাকার ফিশের ক্ষতিকর প্রভাবে ভারত,
মিয়ানমারসহ আরও অনেক দেশের মৎস্য চাষিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাংলাদেশে আসা সাকার
প্রজাতির মাছটি ১৬ থেকে ১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। মাছটি পানি ছাড়াও প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত
বাঁচতে পারে। মৎস্য অধিদপ্তর ইতোমধ্যেই নির্দেশনা দিয়েছে যে, এ মাছ যাতে কোনোভাবেই উন্মুক্ত
ও বদ্ধ জলাশয়ে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে মনিটরিং করা হোক। অধিদপ্তর এ মাছটি চাষ ও
উন্মুক্ত জলাশয়ে পাওয়া গেলে তা নষ্ট করার নির্দেশনাও দিয়েছে।

মহাবিড়ম্বনার এই সাকার ফিশ কীভাবে
জলাশয় থেকে কমিয়ে আনা যায়, তা
নিয়ে গবেষণা করছেন শেরেবাংলা কৃষি
বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।
গবেষণায় দেখা গেছে, এর দেহে শতকরা
৩০ থেকে ৩৫ ভাগ পর্যন্ত আমিষ
রয়েছে। তাই দেশের সাধারণ মানুষ এই
মাছটি খেতে পারবে কিনা বা খেলে
কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে কিনা,
তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। মাছটি
খাওয়ার যোগ্য হলে সঠিক প্রচার ও
বাজারজাতকরণের মাধ্যমে এর চাহিদা
তৈরি করা যেতে পারে। খাদ্য হিসেবে
গৃহীত হলে এটি একদিকে যেমন
আমিষের চাহিদা পূরণ করবে,
অন্যদিকে এর চাহিদা তৈরি হলে সাধারণ জেলে ও মাছ চাষিরা এটি আহরণ ও বিক্রি শুরু করবে। ফলে
অযাচিত এ মাছ কমে আসতে থাকবে। মাছটি যেন আর আমদানি না করা হয় বা দেশে এর কৃত্রিম
প্রজনন যেন ঘটানো না হয়, সে বিষয়েও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। অ্যাকুরিয়ামে লালনের জন্য
বিদেশি মাছ আমদানির ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। গবেষক এবং একই
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাসুদ
রানা বলেন, সাকার ফিশ শুঁটকি করে এর গুঁড়া পোলট্রি বা মৎস্য শিল্পে ব্যবহৃত খাদ্যে আমিষের
উৎস বা ফিশ মিল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এতে এর পরিমাণ জলাশয়ে ক্রমে কমে আসবে।
অ্যাকোয়ারিয়ামের কাচের সঙ্গে লেগে থাকা ময়লা সাকার মাছ খেয়ে ফেলে। এতে কাচ পরিষ্কার থাকে।
এ কারণেই তাঁরা এ মাছ আনেন। কিন্তু এটা কোনো না কোনোভাবে আমাদের প্রকৃতিতে চলে গেছে।
অ্যাকোয়ারিয়াম থেকে এটা কীভাবে প্রকৃতিতে চলে গেল, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না।’ সাকার মাছ
কীভাবে দেশে প্রবেশ করেছে, তা নির্দিষ্টভাবে বলতে পারে না মৎস্য অধিদপ্তরও।
সাকার মাছ আমদানির অনুমোদন নেই। এ ছাড়া দেশের যেসব আন্তনদী (যেসব নদী ভারত ও মিয়ানমার
থেকে দেশে প্রবেশ করেছে) রয়েছে, সেগুলোতে এই মাছ আগে পাওয়া যায়নি। সেগুলোতে পেলেও বলা যেত,
আন্তনদী দিয়ে প্রবেশ করেছে। সাকার মাছের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া, নিয়ন্ত্রণ ও বিকল্প ব্যবহার নিয়ে
গবেষণা করছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। সংস্থাটির মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, দেশের
তিন-চারটি জায়গা থেকে নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে সাকার মাছের মধ্যে ভারী ধাতব পদার্থ রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এখন আমরা সারা দেশ থেকে নমুনা এনে পরীক্ষা করা হচ্ছে। তিন-চার জায়গার নমুনা নাকি
সারা দেশেই সাকার মাছের মধ্যে ভারী পদার্থ রয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।

যদি গবেষণায় দেখা যায়, অন্যান্য
জায়গার সাকার মাছে ভারী পদার্থ
নেই, তাহলে এই মাছ মানুষের খেতে
সমস্যা থাকবে না।’ ভারী পদার্থ না
থাকলে সাকার মাছ দিয়ে মাছ ও
হাঁস-মুরগির খাদ্য তৈরি করা যাবে
বলেও জানান ইয়াহিয়া মাহমুদ। তিনি
বলেন, ‘গবেষণার ফল এলে আমরা
তখন সরকারকে বলব, যে এই মাছ
মানুষের খাওয়ার এবং মাছ ও হাঁস-
মুরগির খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের
উপযোগী কি না। তবে তাৎক্ষণিকভাবে পরামর্শ হচ্ছে, যেহেতু এটা বাড়ছে বেশি, সে জন্য যেখানেই
পাওয়া যাবে, ধরে মেরে ফেলতে হবে।’ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ আরও বলেন, ‘পুকুর
প্রস্তুতের সময় তা শুকিয়ে সব সাকার ধরে মেরে ফেলতে হবে। বন্যা বেশি হওয়ায় পুকুরের চারপাশে জাল
দিয়ে রাখতে হবে যেন সাকার পুকুরে প্রবেশ করতে ও বের হতে না পারে। কুর থেকে সরালেও নদ-নদী ও
খাল-বিল থেকে এ মাছ সরানো কঠিন হবে। সে ক্ষেত্রে সরকার ঘোষণা দিতে পারে, সাকার ধরে দিলে ১০
টাকা করে দেওয়া হবে। তাহলে হয়তো এটা করা সম্ভব।’ উন্মুক্ত জলাশয়ে চলে যাওয়া সাকার মাছ
নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন উল্লেখ করে বাকৃবি অধ্যাপক শাহজাহান বলেন, ‘যাঁরা অ্যাকোয়ারিয়ামে সাকার
মাছ চাষ করেন, তাঁরা যেন এটাকে আর প্রকৃতিতে না ছাড়েন।’